স্ত্রীর শোকে ২২ বছর পাহাড় কেটে বানিয়েছেন রাস্তা

1539

আজকের গল্পটা ১৯৫৯ সালের কোনো এক দুপুরের। সেদিনও সূর্যটা ঠিক মাথার ওপরে ছিল। স্ত্রী ফাল্গুনির জন্য অপেক্ষা করছিলেন দশরথ মাঝি। ফাল্গুনির আসতে দেরি হওয়ায় দশরথ চিন্তায় পড়ে যান, ‘দেরি হচ্ছে কেন?’ ওই তো কে যেন আসছে পাহাড় বেয়ে। না ফাল্গুনি নয়, আসেন একজন গ্রামবাসী। দশরথের আশঙ্কাই সত্য হয়েছে। খাবার নিয়ে আসার সময় পাহাড়ে পা পিছলে পড়ে গেছেন ফাল্গুনি। ফাল্গুনির রক্তাক্ত দেহ গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব নিয়ে যেতে হবে ৭০ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে।

গরুর গাড়ি করে হাসপাতালে নেয়ার সময় দশরথের কোলে মারা যান ফাল্গুনি। এলোমেলো হয়ে যায় দশরথের জীবন। হারিয়ে যায় তার রুক্ষ জীবনের একমাত্র ভালবাসাটুকুও। সমস্ত রাগ ক্ষোভ গিয়ে পড়ে নিস্প্রাণ পাহাড়ের ওপর। ছাগল বেচে দিয়ে কিনলেন হাতুড়ি আর শাবল। প্রতিজ্ঞা করলেন, ‘পাহাড়কে আর কারো প্রাণ নিতে দেবো না।’ তিনি বানাবেন রাস্তা। যাতে গ্রামের মানুষ দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে পারে।0

গেহলৌরের কথা

ভারতের বিহার রাজ্যের গয়া জেলার মুহরা তহশিলের আতরি ব্লকে অবস্থিত প্রত্যন্ত গ্রাম গেহলৌর। গ্রামটিকে পাশের শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে বড় এক পাহাড়, তার নামও গেহলৌর। পাহাড় ঘুরে ওয়াজিরগঞ্জ যেতে গ্রামবাসীকে পাড়ি দিতে হয় প্রায় ৫৫ কিলোমিটার পথ। গ্রামের উন্নয়নের পথেও একদিন প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল গেহলৌর পাহাড়।

এখানকার বাসিন্দারা তথাকথিত নিচু জাতের। সেকারণে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি সেখানে। দারিদ্র, অনাহার, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুকে নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছিলেন গ্রামবাসী। নেই পানীয় জল, নেই বিদ্যুৎ, নেই স্কুল বা হাসপাতালও। সবচেয়ে কাছের হাসপাতালটির দূরত্বই প্রায় সত্তর কিলোমিটার। গরুর গাড়িতে করে মূমুর্ষু রোগীকে নিয়ে যেতে যেতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গ্রামবাসী ফিরে আসে রোগীর মৃতদেহ নিয়ে।

দশরথ মাঝির বাড়ি

দশরথ মাঝির বাড়ি

অবহেলিত গ্রামটির উদাহরণ দেয়ার মতো প্রেমিক জুটি ছিল দশরথ-ফাল্গুনি। বিয়ে করেন দু’জন, সন্তানও হয়। পুত্র ভগীরথ এবং ও কন্যা বাসন্তী। দিন মজুরের কাজ করেন দশরথ। উচ্চবর্ণদের ফসলা জমিতে কাজ করে ফিরে আসেন সন্ধ্যার মধ্যে। দুপুরে দশরথের খাবার ও জল পুঁটলিতে নিয়ে পাহাড় বেয়ে দিয়ে আসেন ফাল্গুনি। অনেক কষ্টে পৌঁছান দশরথের কাছে। কিন্তু একদিন এই পথই কাল হলো ফাল্গুনির। সেই থেকে পাগলপ্রায় দশরথ।

দশরথের রাস্তা বানানো ও গ্রামবাসীর ঠাট্টা

পাথর কাটা মেশিন নেই, হাতুড়ি আর শাবল দিয়ে বানাবে রাস্তা—এই বলে ঠাট্টা তামাশা করতে লাগলেন গ্রামবাসী। কিন্তু দশরথ তার প্রতিজ্ঞায় অটুট থাকেন। ১৯৬০ সাল, এক ভোরে সূর্য ওঠার আগে দশরথ নেমে পড়েন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অসম লড়াইয়ে। হাতুড়ির ঘায়ে পাহাড়ের পাথরে দশরথ মাঝির ক্ষোভের ফুলকি ঠিকরে ওঠে। হাতুড়ির প্রতিটি আঘাত যেন স্ত্রী ফাল্গুনির মৃত্যুর প্রতিশোধ।

গ্রামের লোকেরা খবর পেয়ে দেখতে আসেন ভিড় করে। দশরথ কোনো দিকে তাকান না, কারো কথা শোনেন না। দেহের সব শক্তি একত্রিত করে হাতুড়ির আঘাত হেনেই চলেন পাহাড়ের পাথরে। শরীর থেকে ঝরনার মত ঘাম গড়ায়। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়। মুখে ওঠে ফেনা। হাত ফেটে বার হয় রক্ত। তবে থামেন না অক্লান্ত দশরথ। তার মাথায় একটিই চিন্তা, এর চেয়ে অনেক যন্ত্রণা পেয়েছিল তার ফাল্গুন!

দশরথ মাঝির বানানো রাস্তা

দশরথ মাঝির বানানো রাস্তা

এভাবে কেটে গেল দশটি বছর। গ্রামের লোক অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেন, পাহাড়ের গায়ে এই দশ বছরে বড় একটা ফাটল বানিয়ে ফেলেছেন দশরথ। ফাটলটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। রোদ ঝড় বৃষ্টিতে সবাই যখন ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে, দশরথ তখনো চালিয়ে যান হাতুড়ি। এভাবেই কেটে যায় ২২ বছর। ১৯৮২ সালে পাথরটি কাটা শেষ হবার পর দশরথ তীব্র আক্রোশে সেটি লাথি মেরে গড়িয়ে দেন ঢালু পথে। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়েন। চোখের জলে ভিজে যায় গেহলৌরের আকাশ। আচমকাই মেঘ ভাঙা বৃষ্টি নামে।

খবর পেয়ে গ্রামের লোক ভিজতে ভিজতেই ছুটে আসেন। স্থানু হয়ে দেখেন, পাহাড়ের বুক চিরে শুয়ে আছে ৩৬০ ফুট লম্বা আর ৩০ ফুট চওড়া রাস্তা। গ্রামবাসীরা দশরথকে কাঁধে তুলে নেন, দশরথ কোনো কথা বলেন না। চোখ দিয়ে বইতে থাকে জলের ধারা। রাতে যখন আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে, দশরথ গিয়ে দাঁড়ান পাহাড়ের কোলে, সেই ছোট্ট ডোবাটির ধারে। যেখানে তার প্রিয়তমার চিতা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল কোনো এক সন্ধ্যায়।