সার্টিফিকেট নেই, ৩০ বছর ধরে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার

1727

চিকিৎসাশাস্ত্রে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও প্রায় ৩০ বছর ধরে রোগী দেখছেন। যিনি নিজেকে স্বঘোষিত কিডনী-ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় দেন। স্বঘোষিত এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নাম সালাহ উদ্দিন মাহমুদ। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে রয়েছে তার চেম্বার। নিজস্ব উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে তিনি কিডনী রোগীর চিকিৎসা করেন।

তার ভিজিটিং কার্ডে ডা. শব্দটি তিনি ব্যবহার না করলেও স্বঘোষিত এই চিকিৎসকের চেম্বারের বাইরে সাইনবোর্ডে লিখে রেখেছেন ডা. সালাহ উদ্দিন মাহমুদ। এছাড়া কিডনী রোগ বিষয়ে তিনি বইও লিখেছেন। সেখানেও তিনি নিজের নামের আগে বসিয়েছেন ‘ডাক্তার’ শব্দটি।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সনদ ছাড়া নামের আগে ডাক্তার শব্দটি ব্যবহার করা যায় না। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ডাক্তার শব্দটি ব্যবহার করলে অসুবিধা কি?’ তার সোজা সাপটা উত্তর- ‘আমার বাবা একজন ডাক্তার ছিলেন। ওনার কাছ থেকে শিখেছি চিকিৎসাশাস্ত্রের ৫০ ভাগ। আমি কেমিস্ট্রির ছাত্র, তাই সেখান থেকে শিখেছি ২৫ ভাগ, আর বাকি ২৫ ভাগ আমি গবেষণা করে বের করেছি। ব্যাস হয়ে গেলো শতভাগ।’

পরে অবশ্য বলেন, এজন্য ভবিষ্যতে তাকে সমস্যায় পড়তে হবে, তাও তিনি জানেন। তার বিরুদ্ধে এজন্য মামলাও হয়েছে এবং মামলায় আদালত তার পক্ষে রায়ও দিয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

নিজের নামের আগে ডাক্তার শব্দটি ব্যবহারের পূর্ণ অধিকার তার রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, হোামিওপ্যাথি শাস্ত্রে তিনি পড়াশোনা সম্পন্ন করেছেন। এ জন্য নিজ নামের আগে তিনি ডাক্তার শব্দটি ব্যবহার করতেই পারেন। তবে সালাহ উদ্দিন মাহমুদের পরিচয় সম্বলিত সাইনবোর্ড, বই কিংবা ভিজিটিং কার্ডে হোমিওপ্যাথি ডিগ্রির বিষয়ে কিছুই উল্লেখ নেই।

স্বঘোষিত এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দাবি তার মামা কিডনী রোগ বিষয়ে গবেষণার জন্য আশির দশকে তাকে ৫০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। দীর্ঘ গবেষণার পর তিনি কিডনী রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেন। তার বানানো ওষুধ সেবন করলে ডায়ালাইসিস করা কিডনী রোগীও সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে দাবি করেন তিনি। শুধু তাই নয়, নিজের উদ্ভাবিত ওষুধ দিয়ে তিনি দেশ-বিদেশে লাখো কিডনী রোগীর চিকিৎসা করার স্বপ্ন দেখেন।

শুধু সালাহ্ উদ্দিন মাহমুদই নয়, রাজধানীসহ সারাদেশে রয়েছে এরকম হাজারো ভুয়া ডাক্তার। জানা যায়, বিএমডিসির (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) ২০১০ সালের আইন অনুযায়ী শুধুমাত্র বিএমডিসির সনদ প্রাপ্তরাই নামের আগে ডাক্তার শব্দটি ব্যবহার করতে পারেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভুয়া ডাক্তার তৈরির কারখানা হচ্ছে বিসিএমডিসি (কম্বাইন্ড মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল, বাংলাদেশ) যা বর্তমানে এনএএমডিসি (ন্যাশনাল অল্টারনেটিভ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল, বাংলাদেশ) নামে পরিচিত। প্রতিষ্ঠানটি জয়েন্ট স্টকে রেজিষ্ট্রেশন করে চালিয়ে যাচ্ছে ডাক্তার সার্টিফিকেট বাণিজ্য, যা সম্পূর্ণ অবৈধ।

প্রতিষ্ঠানটি উত্তরায় তাদেরই পরিচালিত ‘পিচ ব্লেন্ড বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে ডাক্তার বানিয়ে বিএমডিসির মত নিজেরাই সনদ দিতো। এখানে যে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যাক্তি প্রশিক্ষণ নিয়ে ডাক্তার হয়ে যেতে পারতেন। তারা শুধু দেশি নয়- ভারত, রাশিয়া, চীনের বিভিন্ন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিও দিতো।

যদিও এই বিশ্ববিদ্যালয়টি সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এর আগেই ভুয়া এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে ১০ হাজার ভুয়া ডাক্তার ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্নস্থানে। যারা নিজেদের নামের আগে ডাক্তার শব্দটি ব্যবহার করে বছরের পর বছর ধরে চেম্বার সাজিয়ে রোগী দেখছেন।

এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের নেতা ডা. এম ইকবাল আর্সনাল বলেন, বিএমডিসি প্রতিষ্ঠানটির (বিসিএমডিসি) উপাচার্য ডা. মো. এম এন হকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা হয় ২০১৮ সালে। আদালত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ও মালামাল ক্রোকের নির্দেশ দেয়। তারপরও তাদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না।

বিএমডিসি’র ভারপ্রাপ্ত রেজিষ্টার ডা. মো. আরমান হোসাইন বলেন, অল্টারনেট মেডিসিনের উপর পড়াশোনা করে কেউ নামের আগে ডাক্তার লিখতে পারেন না। শুধুমাত্র বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশনধারীরাই নামের আগে ডাক্তার লিখতে পারবেন। তিনি আরো বলেন, এনএএমডিসি’র সার্টিফিকেট হুবহু বিএমডিসির মতো দেখতে। প্রতারণার উদ্দেশ্যেই তারা এরকম করছে। তিনি হতাশ কণ্ঠে বলেন, তাদের (এনএএমডিসি) বিরুদ্ধে মামলা হলেও পুলিশ তাদেরকে ধরতে পারছে না!

গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে র‌্যাব-১১ এর একটি দল কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকা থেকে বেশ কয়েকজন ভুয়া ডাক্তারকে গ্রেফতার করে, যাদের প্রায় সবাই পিচ ব্লেন্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারি সার্টিফিকেটধারী।

চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি পাবনার বেড়া বাসস্ট্যান্ডের নুরুন্নাহার ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার থেকে আটক করা হয় ভুয়া ডাক্তার মো. ফরহাদ আলীকে। তিনিও ভারত থেকে এমবিবিএস সার্টিফিকেট কিনে অর্থোপেডিক ডাক্তার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে আসছিলেন। বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আলম সিদ্দিকী অভিযানটি পরিচালনা করেন।

এর আগে গত বছরের ২৮ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জের চাঁন সুপার মার্কেটের ‘কুমিল্লা ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স’ থেকে র‌্যাব-১১ এর অভিযানে আটক করা হয় ভুয়া ডাক্তার জহিরুল ইসলামকে (৪৪)। উচ্চ মাধ্যমিক পাস জহিরুল ইসলাম ৫ লাখ টাকা দিয়ে ভারত থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি কিনে বিগত ১০ বছর ধরে রোগী দেখে আসছিলেন। পরে তিনি এনএএমডিসি থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছিলেন বলে স্বীকার করেন।

গত বছরের ১ ডিসেম্বর বরগুনার পাথরঘাটার কাকচিড়া বাজারের নাসিম ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে আটক করা হয় ভুয়া ডাক্তার ডি কে গোলদারকে।

ভুয়া ডাক্তার প্রসঙ্গে র‌্যাব-১১ এর উপ পরিচালক মেজর তালুকদার নাজমুস সাকিব বলেন, এনএএমডিসি একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান। তারা জয়েন্ট স্টক থেকে রেজিস্ট্রেশন করেছে।

জয়েন্ট স্টক থেকে রেজিস্ট্রেশন করে ডাক্তারি সার্টিফিকেট দেয়ার কোনো নিয়ম নেই জানিয়ে তিনি বলেন, বিএএমডিসি ডাক্তারি সার্টিফিকেট দেয়ার এই থিমটি পায় কলকাতা থেকে। সেখানে এরকম ১০-১২টি প্রতিষ্ঠান আছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কলকাতায় ওইসব প্রতিষ্ঠানের কোনটি তালাবদ্ধ, কোনটি শুধুই নামসর্বস্ব। বিএএমডিসি কলকাতার ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেট কিনে আনাদের স্বীকৃতি দিয়ে নামিয়ে দিচ্ছে চিকিৎসা পেশায়।

এদিকে ভুয়া ডাক্তারের চিকিৎসায় অনেক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ভুয়া ডাক্তারের চিকিৎসায় মারা যান আবু সাঈদ সিদ্দিকী নামে এক যুবক। সাপে কামড়ানো আবু সাঈদকে ভুয়া ডাক্তার আতোয়ার রহমানের কাছে নিয়ে আসলে তিনি ইনজেকশন দেন। এতে মারা যান তিনি। সাঈদের পরিবার জানান, তারা জানতেন না আতোয়ার একজন ভুয়া ডাক্তার।

এছাড়া ২০১৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর বাজারের ইসলামিয়া ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় মারা যান সুকতারা বেগম নামে অপর এক গৃহবধূ। পরবর্তীতে জানা যায়, ভুয়া এনেসথেসিয়া ডাক্তার মো. টুটুলের ভুলে মারা যান ওই গৃহবধূ।