নুসরাত হত্যাকে ‘আত্মহত্যা’বলে প্রমাণের চেষ্টা আইনজীবীদেরফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা মামলায় দু’সহপাঠী নিশাত সুলতানা ও নাসরিন সুলতানা ফূর্তি আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সোমবার (১ জুলাই) ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত স্বাক্ষ্য দেন তারা। এ সময় মামলার আসামি পক্ষের আইনজীবীরা নিশাতের জেরা শেষ করেন। এছাড়া ফূর্তিকে জেরা করেছেন আসামিপক্ষের চার আইনজীবী।
আগামীকাল মঙ্গলবার (২ জুলাই) আসামি পক্ষের অপর ১২ আইনজীবী ফূর্তিকে জেরা করবেন। এরপর মামলার পরবর্তী সাক্ষী মাদ্রাসার অফিস সহকারী নুরুল আমিনের সাক্ষ্যগ্রহণ হবে। বিচারিক আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) হাফেজ আহাম্মদ এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সাক্ষ্যগ্রহণের সময় আসামি পক্ষের আইনজীবী ফরিদ খান নয়ন বলেন, ‘নুসরাত আত্মহত্যা করেছে। কেউ তাকে হত্যা করেনি। তোমরা মিথ্যা স্বাক্ষ্য দিচ্ছো। তোমরা কলেজের ভেতর প্রেম করতে। অধ্যক্ষ তোমাদের শাসন করায় এই স্বাক্ষ্য দিচ্ছো।’
এছাড়া নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যাকে ‘আত্মহত্যা’ বলে প্রমাণের চেষ্টা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। আসামি পক্ষে জেরাকারী আইনজীবীরা হচ্ছেন, অ্যাডভোকেট কামরুল হাসান, গিয়াস উদ্দিন নান্নু, মাহফুজুর রহমান, নুরুল ইসলাম ও আহসান কবির বেঙ্গল।
বাদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহজাহান সাজু বলেন, ‘নুসরাতের সহপাঠী নাসরিন সুলতানা ফূর্তি আদালতকে জানান, ২৮ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার খুব কাছের মানুষ নুর উদ্দিন নুসরাতকে তার মায়ের মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দেন এবং আইসিটি পরীক্ষার ভাইভায় ফেল করিয়ে দেবেন বলে জানান। ৪ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার্থী মো. শামীম নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয়।
এরপর ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাত আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে তাকে জানানো হয়, নিশাত সুলতানাকে মাদ্রাসার প্রশাসনিক ভবনের তৃতীয় তলার ছাদে মারধর করা হচ্ছে। সেখানে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নিতে ফের চাপ দেওয়া হয়। নুসরাত এতে অস্বীকৃতি জানালে তার হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় শামীম, জাবেদসহ পাঁচজন। ওই সময় নিজেদের পরিচয় গোপন করতে শামীম, জাবেদসহ তিনজন হাত মোজা ও বোরকা পরেছিলেন। পাঁচজনের মধ্যে দু’জন নারী ছিলেন।’
নিশাত সুলতানা স্বাক্ষ্য দেওয়া সময় বলেন, ‘২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা তাকে তার কক্ষে ডেকে পাঠান। মাদ্রাসায় ও পরীক্ষায় নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলেন অধ্যক্ষ। সেই সঙ্গে বাড়িতে দাওয়াত দেওয়ার জন্য বলেন। সব শেষে গায়ে হাত দিয়ে যৌন হয়রানির চেষ্টা করেন তিনি। অধ্যক্ষের এ ধরনের আচরণের বিষয়টি রাতে তার বাবাকে জানান। তার বাবা এই ঘটনার প্রতিকার চেয়ে মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বরাবর লিখিত আবেদন করেন। কিন্তু মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদ এতে সাড়া না দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়।’
তিনি আরও জানান, গত ২৭ মার্চ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নুসরাতকে তার কক্ষে ডেকে পাঠান। এ সময় নুসরাতের সঙ্গে তিনি ও নাসরিন সুলতানা ফূর্তি যান। কিন্তু তাদের দু’জনকে অধ্যক্ষের কক্ষে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। অধ্যক্ষ ওই দিন নুসরাতকে যৌন হয়রানি করেন। এই ঘটনায় নুসরাতের মা বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন।
এর আগে ২৭ ও ৩০ জুন নুসরাত হত্যা মামলার বাদী ও নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানকে জেরার মধ্য দিয়ে বহুল আলোচিত এ মামলার বিচার কাজ শুরু হয়। আদালত সূত্র জানায়, ২৯ মে, আদালতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে ৮০৮ পৃষ্ঠার চার্জশিট দাখিল করে। ৩০ মে, মামলাটি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে স্থানান্তর হয়। ১০ জুন মামলাটি আমলে নিয়ে শুনানি শুরু হয়। ২০ জুন অভিযুক্ত ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত।
এ মামলায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের ও জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন।
প্রসঙ্গত, সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান ওরফে রাফিকে গত ৬ এপ্রিল গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে মারা যান তিনি। এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে আটজনকে আসামি করে সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। পরে মামলাটি পিবিআইতে স্থানান্তর করা হয়। পুলিশ ও পিবিআই এই মামলায় ২১ জনকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে ১২ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
এর আগে গত ২৭ মার্চ নিজ কক্ষে ডেকে নুসরাতকে শ্লীলতাহানি করেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। এ ঘটনায় নুসরাতের মা বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করলে পুলিশ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। ওই মামলা তুলে না নেওয়ার কারণে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় নুসরাতকে।
সূত্র – নতুন সময়