গতানুগতিক ধারায় আ.লীগ-বিএনপি

1606

চলতি বছরে রাজনীতিতে তেমন কোনো বড় চমক বা নতুনত্ব থাকছে না। দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং তাদের নেতৃত্বাধীন জোট গতানুগতিক কর্মসূচির মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবে। দুই দলই তাদের অভ্যন্তরীণ শক্তি বাড়াতে কাজ করবে।

চলতি বছরে দলের কাউন্সিল ঘিরে সব মনোযোগ দিচ্ছে আওয়ামী লীগে। অন্যদিকে বিএনপি এ সময়ে অভ্যন্তরীণ বিভেদ দূর করে বড় জোট গড়তে কাজ করছে। গত মার্চে বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও শিগগিরই নতুন কাউন্সিল করার চিন্তা বিএনপিতে এখনো নেই। 

রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই মুহূর্তে রাজনীতিতে ভারসাম্য নেই। সরকারি দল আওয়ামী লীগ ‘একচ্ছত্র’ অবস্থান বজায় রেখেছে। তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নানা সংকটে বিপর্যস্ত। সরকারকে কোনো ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ করার মতো শক্তি দলটির নেই। এটাকে ‘শূন্যতা’ উল্লেখ করে তাঁরা বলছেন, রাজনীতির জন্য এটা ভালো নয়। সব রাজনৈতিক দল যদি রাজনীতির মাঠে সমান সুযোগ না পায় তাহলে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের উত্থান হতে পারে, যা দেশের জন্য মোটেই ভালো হবে না। 

একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন উল্লেখ করে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছিল বিএনপি। বহু নাটকীয়তা পর এবং দল-জোটের সমালোচনার মুখে বিএনপির একজন ছাড়া সবাই সাংসদ হিসেবে শপথ নেন। এরপরই দলটির বিভিন্ন নেতার বক্তব্যে অভ্যন্তরীণ বিভেদের বিষয়টি সামনে এসেছে। দল গোছাতে গিয়েও বেগ পেতে হচ্ছে দলটির নেতাদের। দলটির সমস্যার শুরুও এখানে। আর চেয়ারপারসন জেলে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন বিদেশে থাকায় দলটির নেতৃত্ব সংকটও এখন সামনে এসেছে।

অন্যদিকে ভোটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগ সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতারা ব্যস্ত বিভাগীয় ও জেলা সদরে সাংগঠনিক সফরে। সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ না থাকায় রাজনীতির মাঠে এবং সরকার পরিচালনায় আওয়ামী লীগ এখন দৃশ্যত একচ্ছত্র অবস্থান বজায় রেখেছে। আওয়ামী লীগের কোনো কাজের সমালোচনা করে কেউ রাজপথ কাঁপাবে এমন কোনো সংগঠন বা শক্তি রাজনীতিতে অনুপস্থিত।

আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেছেন, দিবস ধরে তাদের কর্মসূচি থাকবে। কাউন্সিল উপলক্ষে বিভিন্ন কমিটি গঠন, পুনর্গঠন, নেতাদের মাঠপর্যায়ের সফর কর্মসূচি থাকবে। এই বাইরে বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি আপাতত থাকছে না। ওই নেতা বলেন, বিরোধী দল কি ধরনের কর্মসূচি দেয়, তাদের সরকারবিরোধী কর্মসূচি কতটা শক্তিশালী হয় সেগুলো দেখে তারা অন্য কর্মসূচি নির্ধারণ করবেন। তবে এই নেতা মনে করেন, এখনই সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার মতো কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামার মতো অবস্থা বিরোধী দলগুলোর নেই।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতিতে এমন কোনো অবস্থা তৈরি হয়নি যে সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো বড় ধরনে আন্দোলন করতে পারবে। সব দল এখন জাতীয় সংসদে এসেছে। সেখানেই অনেক আলোচনা হবে। সমাধানও হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণকে নিয়ে যেকোনো অশুভ ও অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রতিহত করবে। তিনি জানান, আওয়ামী লীগ সারা বছরই নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে, আগামী দিনগুলোতেও থাকবে।

অন্য দিকে বিএনপি জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রথম আলোকে বলেছেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সরকার শুধু যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা করে তা তো নয়, জনগণও নিজেদের প্রতারিত ভাবছে। তারাই জবাব দেবে। বিএনপির দিক থেকে জনগণই ঐক্যবদ্ধ করার কাজ চলছে।

অবশ্য বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেছেন, এখনই ‘অলআউট’ কর্মসূচিতে যাওয়ার মতো শক্তি তাদের নেই। দলে নেতৃত্ব নিয়েও সমস্যা আছে। এ অবস্থায় নতুন নির্বাচনের দাবিতে এবং বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন, সভা, সমাবেশের মতো কর্মসূচি পালিত হবে। তবে আরও দল নিয়ে একটি বড় জোট গঠনের লক্ষ্যে তারা কাজ করছেন।

বিএনপির একটি জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকায় তাঁর বাসায় সাংবাদিকদের বলেছেন, নতুন নির্বাচনের দাবিতে তাঁরা চলতি বছরে আন্দোলন জোরদার করবেন। জোটের আকার বাড়ানোর কথাও বলেন এই নেতা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির বিদ্যমান জোটগুলো টিকে থাকলে আন্দোলন সম্ভব। আর নতুন কোনো মঞ্চ হলে তা খারাপ হবে না। বরং আন্দোলন জোরদার হবে। 

দুই জোটে টানাপোড়েন এবং রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজেদের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতেই বিএনপির মধ্যে নতুন রাজনৈতিক জোট বা মঞ্চের প্রসঙ্গটি জোরালো হচ্ছে। বিএনপির একটি সূত্র জানায়, এ জোটের আলোচনা অনানুষ্ঠানিকভাবে হচ্ছে। জোট বা মঞ্চ ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম ঐক্য পরিষদ’ নামে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০-দলীয় জোটের জামায়াতে ইসলামী বাদে অন্য শরিকেরা এবং ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের নিয়ে নতুন পরিকল্পনাটি হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের বৈঠকে জোটের আকার বাড়ানো ও একটি জোট করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতি না থাকলে সংকট তৈরি হয়। এখন সরকারি দল বিরোধীদের রাজনীতিতে ‘স্পেস’ দিচ্ছে না। এটা ঠিক হচ্ছে না। এ ধরনের শূন্যতা তৈরি ঠিক হচ্ছে না। অন্যদিকে বিএনপিও আন্দোলন জোরদার করতে পারছে না। সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারছে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের—সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দীন মনে করেন, আন্দোলন বা পাল্টা আন্দোলন কিংবা আন্দোলন দমন করার মধ্যে সুস্থ রাজনীতির কোনো লক্ষণ নেই। এখন দরকার সুষ্ঠু নির্বাচন ও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা। তিনি মনে করেন, আন্দোলন হতে হবে রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি গুণগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে।

সূত্র – প্রথম আলো