কোনো পাপ করে ফেলেছেন, সমাধান যে পথে..

1834

মানুষ ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক। আরবিতে প্রবাদ আছে, ‘প্রথম মানুষ প্রথম ভুল’। অর্থাৎ মানব জাতির আদি পিতা আদম ও মা হাওয়া (আ.) দ্বারাই প্রথম ভুল হয়ে ছিলো।

যদিও ওই ভুল আর আমাদের ভুলের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। আমাদের মাঝে অনেকে ভুল পথে পরিচালিত হয়। জেনে, না জেনে পাপ ও অন্যায়ের দিকে ধাবিত হয়। বড়দের দায়িত্ব সেগুললো সংশোধন করা। 

কিন্তু ভুলের সংশোধন কীভাবে করতে হয় না জানার কারণে, সংশোধন করতে গিয়ে বড়রাও ভুল করে ফেলেন। ভুলকারীকে এত বেশি ভয় দেখানো হয় যে, ভুলকারী সংশোধনের আশাই ছেড়ে দেন। হতাশ হয়ে ভাবতে থাকেন, ফিরে আসলেই বা কী হবে। তখন সে ওই পথে আরো বেশি উদ্দমতার সঙ্গে ধাবিত হয়। এভাবেই একদিন সে নিজকে শেষ করে দেয়। অথচ রাসূলের (সা.) আদর্শ ছিলো মানুষকে সুসংবাদ দিয়ে ভালোর পথে নিয়ে আসা। ভীতি প্রদশর্ন করে দূরে ঠেলে দেয়া নয়।

হজরত মুআজ ও আবু মূসা আশআরী (রা.)-কে ইয়ামানে গভর্ণর হিসেবে প্রেরণ করা হয়। ইয়ামানের মানুষ ছিলো নও মুসলিম। তাই নবী করিম (সা.) তারা দু’জনকে বলে দিলেন, সেখানে গিয়ে মানুষের সহজের চিন্তা করবে, কঠোরতা করবে না। সুসংবাদ শুনাবে কখনো দূরে ঠেলে দিবে না।’ (মুসনাদে আহমদ: ১৯৭৪২)।

ভুলের সংশোধন সহজভাবে করার দৃষ্টান্ত আল কোরআনের বহু জায়গায় পাওয়া যায়। অন্যায় করতে করতে যাদের দিল কালো হয়ে গিয়েছে, আল্লাহ তায়ালা কত সুন্দর ভাষায় তাদেরকে ফিরে আসতে বলেছেন! আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী আমার পক্ষ থেকে বলে দিন, ‘হে আমার ওই সব বান্দা! যারা নিজেদের ওপর অবিচার করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় তিনি সব গুনাহ ক্ষমা করে দেন। তিনিই তো অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা: যুমার: ৫৩)।

বান্দার প্রতি আল্লাহর মহব্বত কত বেশি তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আয়াতে অন্যায়কারীদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু অন্যায়কারী বলে সম্বোধন করেননি। নিজের বান্দা বলেই সম্বোধন করেছেন। দুনিয়াতে সন্তানের সবচেয়ে কাছের মানুষ পিতা-মাতা। সন্তানের অন্যায় মাত্রাতিরিক্ত হলে অনেক সময় পিতা-মাতাও সন্তানের পরিচয় অস্বীকার করে। কিন্তু ‘নিজের বান্দা’ এই পরিচয় আল্লাহ তায়ালা অস্বীকার করেননি। শত ভুলের পরও বান্দা বলে ডেকেছেন। এবং ফিরে এলে ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

সূরা ফুরকানের ৬৮ নম্বর আয়াত নাজিল হলো। সেখানে তাওহীদের বিশ্বাসী, হত্যা ও ব্যভিচার থেকে বিরত ব্যক্তির জন্য পরকালে জান্নাতের সুসংবাদ রয়েছে। আর যারা এগুলোর বিপরীত করে তাদের জন্য রয়েছে আজাবের হুমকি। মক্কার মুশরিক সম্প্রদায় আয়াত শুনে বলা শুরু করলো ‘আমরা ইসলাম গ্রহণ করলেই বা কি হবে? আমরা তো মানুষ হত্যা করেছি। ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছি। আল্লাহ আমাদের এতগুলো অন্যায় ক্ষমা করবেন? তারা বিষয়টি কঠিন মনে করল।

আল্লাহ তায়ালা তাদের অতিতের ভুলের সংশোধন খুব সহজভাবে করে দিলেন। বলে দিলেন, যারা অতিতে ওই সব অন্যায়ে লিপ্ত হয়ে ভুল করেছে তাদের দু’টি কাজ করলেই হবে। শুধু গোনাহ মাপ হবে তাই নয়। বরং আল্লাহ তায়ালা অতিতের গোনাহকে নেকি দ্বারা পরিবর্তন করে দিবেন। প্রথম কাজ হচ্ছে, তওবা করে ফিরে আসতে হবে। দ্বিতীয় কাজ হলো নেকির কাজ বেশি বেশি করতে হবে (সহিহ মুসলিম: ৩০২৩)।

মক্কার লোকের ইহরাম বাঁধার পর কোনো কাজের জন্য বাড়িতে এলে দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতো না। এটাকে তারা অন্যায় মনে করতো। এ জন্য তারা ছাদ দিয়ে ঘরে অবতরণ করতো। অথবা পেছনের দিক দিয়ে ফাঁক করে ঘরে প্রবেশ করতো। এটা ছিলো ভ্রান্ত কুসংস্কার। আল্লাহ তায়ালা কত সহজভাবে তাদের সংশোধন করে দিলেন। কোরআনের ভাষায় ‘এ কোনো পুণ্য নয় যে তোমরা ঘরের পেছন দিক থেকে ঘরে আসবে। পুণ্য তো হলো আল্লাহর ভয়। অতএব, তোমরা ঘরে আস, তার দরজা দিয়ে এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১৮৯)। উল্লিখিত আয়াত দ্বারা এ কথাও প্রতীয়মাণ হয়, সংশোধনকারীর দায়িত্ব শুধু ভুল ও ব্যর্থতার দিকগুলো ধরিয়ে দেয়া নয় বরং সফল হওয়ার পদ্ধতি বাতলে দেয়াও কর্তব্য।
 
নবী করিম (সা.) মানুষের ভুলকে সজহভাবে নিতে শিখিয়েছেন। সমাধানও তিনি দিয়েছেন সহজভাবে। তাঁর ভাষ্য হলো ‘প্রত্যেক আদম সন্তান ভুলকারী। ভুলকারীদের মাঝে উত্তম হলো যারা তওবা করে নিজেকে শুধরে নেয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-৪২৫১)। তাছাড়া নবী করিম (সা.) এর সীরাতে বহু ঘটনা এমন ঘটেছে, যা দেখে মনে হতো এর সমাধান সহজভাবে হবে না। কিন্তু রাসূল (সা.) বিষয়টিকে এত সহজভাবে নিতেন যা কখনো কল্পনায়ও আসতো না। সামনে এমন কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো।

এক লোক নবী করিম (সা.) এর নিকট এসে আক্ষেপ প্রকাশ করল যে, সে অনেক বড় অন্যায় করেছে। এখন সে ওই অন্যায়ের কুফল থেকে রেহাই চায়। তাই সে রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করে, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার তওবা কবুল হবে? আল্লাহ তায়ালা আমাকে মাফ করবেন? রাসূল (সা.) তার কাছে জানতে চায়, তোমার মা জীবিত আছেন? সে উত্তর দেয়, না। রাসূল (সা.) আবার জানতে চান, তোমার খালা জীবিত আছেন? সে বলে, হ্যাঁ। তখন রাসূল (সা.) বলেন, তুমি গিয়ে তোমার খালার সেবা করবে। এর দ্বারাই তোমার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।’ হাদিসটি হজরত ইবনে ওমর (রা.) এর সূত্রে, ইমাম তিরমিজি (রাহ.) স্বীয় গ্রন্থ ‘সুনানে তিরমিজিতে বর্ণনা করেছেন (হাদিস নম্বর: ১৯০৪)।

মানুষের বড় ভুলের সংশোধন সহজভাবে করার অনন্য দৃষ্টান্ত এই হাদিস । আমরা এখন সহজ পদ্ধতি থেকে সরে কঠিন থেকে কঠিনতম পদ্ধতিতে সংশোধনের চেষ্টা করি। এতে মানুষের মানসিকতা অনেক সময় বিগড়ে যায়। সে বিপথগামী হয়ে সংশোধনকারীর ওপর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। তাই কঠোরতা করলে সংশোধন সহজ হবে এই মানসিকতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

হজরত আয়শা (রা.) রাসূল (সা.) এর সবচেয়ে কাছের মানুষ। রাসূল (সা.) জীবনের শেষ দিনগুলো তার ঘরেই কাটিয়েছেন। মৃত্যুর পর হজরত আয়শা (রা.) এর হুজরাতেই রাসূলের লাশ দাফন করা হয়েছে। মসজিদে নববীতে রাসূলের রওজা শরিফটিই হচ্ছে আয়শার ওই ঘর। এত কাছের মানুষের ব্যাপারেই ঘটেছিলো হৃদয়বিদারক এক ঘটনা। যার বিবরণ হচ্ছে রাসূল (সা.) প্রত্যেক সফরে নিজের কোনো স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এর জন্য লটারিও হত।

বনু মুসতালিক যুদ্ধে হজরত আয়শা (রা.) এর নাম লটারিতে ওঠে। সফর শেষে ফিরে আসার সময় রাস্তায় কিছু সময়ের বিরতি হয়। হজরত আয়শা (রা.) প্রয়োজন সারার জন্য বাহন থেকে নেমে একটু দূরে গেলেন। ইতোমধ্যে রাসূল (সা.) কাফেলা রওয়ানার নির্দেশ দিলেন। হজরত আয়শা (রা.) পালকির মতো যে বাহনে বসে যেতেন তা কয়েকজন বহন করত। হজরত আয়শা (রা.) অনেক হালকা ছিলেন। তাই বাহকরা ওঠানোর সময় টের পাননি যে, হজরত আয়শা (রা.) ভেতরে নেই। আয়শা (রা.) ফিরে এসে দেখেন ময়দান ফাঁকা। তাই তিনি কাপড় মুড়ি দিয়ে একটা গাছের নিচে বসে যান। তাঁর ধারণা ছিলো, যখন বুঝতে পারবে আমি ভেতরে নেই তারা আবার আমাকে নেয়ার জন্য এখানেই আসবেন। 
সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল (রা.)-কে নবী করিম (সা.) পেছনে রেখে এসেছিলেন। তার দায়িত্ব ছিলো কাফেলা ভুলে কোনো কিছু রেখে এলে বা পড়ে গেলে তা নিয়ে আসা। তিনি হজরত আয়শা (রা.)-কে দেখে জোর আওয়াজে ইন্না নিল্লাহ পড়লেন। স্বীয় বাহনের ওপর ওঠিয়ে হজরত আয়শাকে নিয়ে এলেন। তাদের মাঝে কোনো কথাই হয়নি। কিন্তু মুনাফিক সম্প্রদায় হজরত আয়শার চরিত্রে অপবাদ দিল। রাসূল (সা.) এ ব্যাপারে হজরত আয়শাকে কিছু বলেননি। তবে তার সঙ্গে রাসূলের আচরণ পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক ছিলো না। বিষয়টি হজরত আয়শা (রা.)-ও কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। কয়েক দিন অসুস্থ থেকে হজরত আয়শা (রা.) বাপের বাড়িতে চলে যান।

অপবাদের বিষয়ে রাসূল (সা.) সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। কিন্তু সেখানেও গৃহযুদ্ধের অবস্থা তৈরি হয়। পরিবারের লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। ইতোমধ্যে হজরত আয়শা (রা.) বিষয়টি জেনে ফেলেন। তো একদিন নবী করিম (সা.) হজরত আবু বকরের বাড়িতে এসে আয়শা (রা.)-কে বলেন, হে আয়শা! তুমি যদি দোষ না করে থাক তাহলে আল্লাহ তায়ালা অচিরেই তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করবেন। আর কোনো গোনাহ তোমার দ্বারা যদি হয়েই থাকে তাহলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। তার কাছে তওবা কর। কারণ, বান্দা যখন স্বীয় ভুলের কথা স্বীকার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় আল্লাহ তায়ালা তার তওবা কবুল করেন।

তখন আয়শা (রা.) স্বীয় পিতা আবু বকরকে রাসূলের (সা.) কথার জবাব দিতে বলেন। কিন্তু আবু বকর (রা.) কী জবাব দেবেন বুঝতে পারেনি। তখন হজরত আয়শা (রা.) বলেন, মানুষের কথা শুনতে শুনতে আপনাদের মনে হয়তো একটা বিষয় বসে পড়েছে। তাই আমি সত্য কথা বললে আপনাদের বিশ্বাস হবে না। যদি স্বীকার করে নেই, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তো জানেন আমি নির্দোষ। তাই আমি ওই কথাই বলবো, যা ইউসূফ (আ.) এর বাপ বলেছিলেন ‘উত্তমরূপে ধৈর্য ধারণ করা, আল্লাহই সাহায্য করবেন, তারা যা বর্ণনা করছে সে বিষয়ে।’ এর পরেই আয়াত নাজিল হয়। আয়শা (রা.) নির্দোষ প্রমাণিত হন।’ (সহিহ বুখারী-৪১৪০)।

এই ঘটনায় সমস্যা কত গুরুতর ছিলো আন্দাজ করাও মুশকিল। কিন্তু আয়শা (রা.) এর কাছে গিয়ে নবী করিম (সা.) সমাধান দিলেন কত সহজে! এটাই ইসলামের শিক্ষা যে, কঠিন সমস্যার সমাধান হবে সহজভাবে। বড় থেকে বড় ভুলের সংশোধন হবে কোমল আচরণের মাধ্যমে।