ইতিহাসে মাত্র ৩৮ মিনিটে শেষ হয়েছিল চাঞ্চল্যকর এই যুদ্ধ

1515

ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় অনেক অনেক যুদ্ধ সম্পর্কে। যুদ্ধ বলতেই আমরা জানি, তার ব্যাপ্তিকাল মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। কিন্তু জানেন কি, ইতিহাসে এমন এক যুদ্ধও আছে যা শেষ হতে এক ঘন্টাও লাগেনি। মাত্র ৩৮ মিনিটেই শেষ হয়েছিল সেই যুদ্ধ। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? চলুন তবে জেনে নেয়া যাক সেই স্বল্প সময়ের যুদ্ধ সম্পর্কে-

১৮৯৬ সালে অ্যাংলো-জানজিবার যুদ্ধটির ব্যাপ্তি ছিল মাত্র ৩৮ মিনিট, যে কারণে এটি বিশ্ব ইতিহাসে পরিচিতি পেয়েছে সর্বকালের ক্ষুদ্রতম যুদ্ধ হিসেবে। এই যুদ্ধের মাধ্যমে জানজিবারের উপর ব্রিটিশ সাম্রাজের একচ্ছত্র আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল, ব্রিটিশদের কাছে আফ্রিকার দেশটি ঠিক কতটা অসহায়। তবে এটিকে অনেকে যুদ্ধ বলে স্বীকার করতে চান না। কেননা এ যুদ্ধে জানজিবারের জয়ের কোনো সম্ভাবনাই যে ছিল না।

প্রেক্ষাপট
যুদ্ধটি হয়েছিল ১৮৯৬ সালে। অর্থাৎ সময়কাল উনবিংশ শতাব্দীর একদম শেষ ভাগ। আফ্রিকা মহাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে, সেখানকার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলো। আফ্রিকার রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে নিয়ন্ত্রণ করতো ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন এবং জার্মানির মতো দেশগুলো। মাঝেসাঝে আফ্রিকার দেশগুলো তাদের ঔপনিবেশিক প্রভুদের বিরুদ্ধে বিপ্লব করতো বটে, তবে তাতে খুব একটা লাভ হতো না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত আফ্রিকার অনেক দেশই তাদের ইউরোপীয় মালিকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি।

অ্যাংলো-জানজিবার যুদ্ধটি ছিল এই ঔপনিবেশিক বিরোধেরই একটি অংশ। ১৮৯৬ সালের ২৫ আগস্ট, ক্ষমতায় বসার মাত্র তিন বছরের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন জানজিবারের ব্রিটিশবান্ধব সুলতান হামাদ বিন থুয়াইনি। তার মৃত্যুর পর সিংহাসন দখল করেন তারই চাচাতো ভাই খালিদ বিন বারঘাশ। সে সময় গুজব রটেছিল, নতুন সুলতানই নাকি আগের সুলতানকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছেন। সম্ভবত এ কারণে যে, খালিদ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পক্ষপাতি ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন তার দেশ যেন সার্বভৌমত্ব ফিরে পায়। যার ফলে তারা তৎকালীন আফ্রিকায় প্রচলিত দাস বাণিজ্যের মাধ্যমে বড় অংকের লাভ করতে পারে। কিন্তু ব্রিটিশরা ক্ষমতা অধিগ্রহণের পর দাস বাণিজ্য পুরোপুরি বিলুপ্ত করে দিয়েছিল। এ কারণে ব্রিটিশদের উপর মনে মনে নাখোশ ছিলেন খালিদ।

ব্রিটিশ সরকার চেয়েছিল যেন দেশটির নতুন সুলতান হিসেবে সিংহাসনে বসেন হামোদ বিন মুহাম্মাদ। তাই তারা খালিদকে ২৭ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল ব্রিটিশবান্ধব উত্তরসূরির কাছে ক্ষমতা বুঝিয়ে দেয়ার।

কিন্তু খালিদ ভেবেছিলেন, ব্রিটিশরা বুঝি তাকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করছে। সেজন্য তিনি তার রাজকীয় প্রাসাদের চারদিক ঘিরে ফেলেন প্রহরী ও কামান দিয়ে। এদিকে পাঁচটি ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি জাহাজ, যা ওই সময়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা। যেটি ভেড়ানো ছিল প্রাসাদের অদূরে নৌ বন্দরে। রয়্যাল মেরিন ও নাবিকরা ভূমিতে অবতরণ করে অপেক্ষা করছিল রিয়্যার অ্যাডমিরাল হ্যারি রওসনের আদেশের, যিনি এই পুরো ঘটনায় কমান্ডিং অফিসারের ভূমিকা পালন করছিলেন।

অ্যাংলো-জানজিবার যুদ্ধ
ঠিক ৯ টার সময়, যখন খালিদ ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানালেন, ব্রিটিশদের তরফ থেকে অবিরাম বোমাবর্ষণ শুরু হলো। জাহাজ থেকে গুলি করা হতে লাগলো সুলতানের প্রাসাদে। প্রাসাদের কাঠের কাঠামোর কোনো সম্ভাবনাই ছিল না ব্রিটিশ আক্রমণের মুখে টিকে থাকার।

খালিদের নৌবাহিনীতে ছিল একটিই জাহাজ। গ্লাসগো নামের সেই জাহাজটি ছিল রানী ভিক্টোরিয়ার কাছ থেকে উপহার পাওয়া একটি বিলাসবহুল ইয়ট। সেটি যুদ্ধের জন্য একদমই উপযোগী ছিল না। বিশেষ করে রয়্যাল নেভির সর্বাধুনিক নৌ পরাশক্তির কাছে সেটি ছিল নেহাতই নস্যি।

পাঁচটি রয়্যাল নেভির জাহাজ, যার নেতৃত্বে ছিল এইচএমসএস (হার ম্যাজেস্টি’স শিপ) সেইন্ট জর্জ, রওসনের নির্দেশে গ্লাসগোকে গুঁড়িয়ে দেয় এবং এর নাবিকদের উদ্ধার করে।

মাত্র ৩৮ মিনিট পরই, খালিদের সৈন্যরা প্রাণ বাঁচাতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে কম ব্যাপ্তির যুদ্ধটির। খালিদ এবং তার কাছের কয়েকজন জার্মান দূতাবাস পর্যন্ত যেতে সমর্থ হয় এবং সেখানে আশ্রয়ের অনুরোধ জানায়। ব্রিটিশরা শেষ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় খালিদকে বন্দি করতে পারে। তখন তিনি নির্বাসনে চলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এবং জানজিবারে নিজের সুলতানির দাবি পরিত্যাগ করেন।
 
এ যুদ্ধে ব্রিটিশ ও ব্রিটিশবান্ধব জানজিবার শক্তি ১০০০ জনের মধ্যে মাত্র একজন যোদ্ধাকে হারায়। অন্যদিকে খালিদের দলের ৩০০০ জন সৈন্যের মধ্যে ৫০০ জন মারা যায়, এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। খেয়াল করেছেন নিশ্চয়, মানবশক্তিতে খালিদের দল ব্রিটিশদের থেকে তিনগুণ এগিয়ে ছিল। কিন্তু তারপরও অস্ত্রসস্ত্র ও সামরিক শক্তিতে তারা ব্রিটিশদের চেয়ে বহুগুণে পিছিয়ে ছিল। তাছাড়া খালিদ এটিও বুঝতে পারেননি যে ব্রিটিশরা সামগ্রিকভাবে ঠিক কত বেশি শক্তিধর।

ব্রিটিশরা যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেয়ার কিছুকাল পরই, দেশটির ক্ষমতা তাদের পছন্দসই ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়। এর এক বছর পর জানজিবারে দাসপ্রথা আইন করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

এরপর ব্রিটেন আরো ৬৭ বছর জানজিবারের ক্ষমতা ধরে রাখে। এমনকি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও তারা দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। ১৯৬৩ সালে জানজিবারের উপর থেকে ব্রিটেনের অভিভাবকত্বের মর্যাদা কেড়ে নেয়া হয়। পরের বছর দেশটি তাঙ্গানিকা প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। য়ার কিছুকাল পরেই, তাঙ্গানিকার তান এবং জানজিবারের জান শব্দের সমন্বয়ে দেশটির নতুন নাম রাখা হয় তানজানিয়া। এই মুহূর্তে জানজিবার তানজানিয়ার একটি আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল।